ওয়াসওয়াসা রোগ বা ওসিডির চিকিৎসা পদ্ধতি:
প্রথমেই প্রশ্ন ওঠে, এই রোগের কি কোনো কার্যকরী চিকিৎসা আছে? নাকি রোগীকে সারাজীবন এই কষ্ট নিয়ে থাকতে হবে? সময়ের সাথে রোগ আরও খারাপ হয় নাকি উন্নতি সম্ভব?
ওয়াসওয়াসা রোগে আক্রান্ত কেউ কি কখনো মানসিক ভারসাম্য হারাতে পারে? আরো নির্দিষ্ট করে বললে, এই রোগ কি তাকে মানসিক রোগীতে পরিণত করে দিতে পারে?
এই সব প্রশ্নই রোগীদের মনের আকুতি থেকে বের হয়। তবে যাদের ঈমান ও ইয়াক্বিন মজবুত তারা নিশ্চিতভাবেই জানেন যে, প্রতিটি রোগের কোনো না কোনো প্রতিকার আছে, আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিকার হল ঈমান।
এরপরে আসে আল্লাহর দানকৃত জ্ঞান, যার মাধ্যমে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ধরণের চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। এতে কিছু রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যান, কিছু কিছু ক্ষেত্রে কিছু উপসর্গ অব্যাহত থাকতে পারে। তবে রোগী স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন, যদিও একদম নিখুঁত সুস্থ জীবন এমনিতেও কারো জন্য থাকে না, সবারই কিছু না কিছু রোগব্যধি থাকে। একইভাবে, একদম দুঃখহীন জীবনও কেউ পায় না।
চিকিৎসার ধরণ:
চিকিৎসার বিভিন্ন ধরণ রয়েছে, যার মধ্যে প্রধানগুলি হলো:
১. ধর্মীয় চিকিৎসা: কুরআন, হাদিস এবং বৈধ জিকিরের মাধ্যমে চিকিৎসা OCD এর প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকরী এবং সঠিক পদ্ধতিগুলোর একটি হিসাবে গণ্য হয়।
ইবনে আব্বাস রা. বর্ণিত হাদিসে আছে, এক ব্যক্তি নবী সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললেন, “ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমি নিজের মধ্যে কিছু চিন্তা করি যা থেকে আকাশ থেকে পড়ে যাওয়া আমার কাছে প্রিয়।” তখন নবীজি ﷺ বললেন: “আল্লাহ্ সবচেয়ে মহান, যিনি এই চক্রান্তকে শুধুমাত্র কুমন্ত্রণা পর্যন্ত সীমিত রেখেছেন।” (আহমাদ ১/২৩৫)
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত আছে, নবী ﷺ বলেছেন: “শয়তান তোমাদের মনে মধ্যে প্রশ্ন তৈরি করবে, এটা কে সৃষ্টি করেছে, ওটা কে সৃষ্টি করেছে? এক পর্যায়ে সে বলবে, তোমার প্রভুকে কে সৃষ্টি করেছে? এমন অবস্থায় আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাও (আউযুবিল্লাহ... পড়ো) এবং থেমে যাও।” (বুখারি ৩২৭৬)
আব্দুল্লাহ বিন জায়েদ রা. থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী ﷺ-এর কাছে অভিযোগ করলেন যে তিনি প্রায়ই নামাজে দাড়া (ওযু ভেঙ্গে যাওয়ার মত) কিছু অনুভব করেন। নবীজি ﷺ বললেন, “যতক্ষণ না শব্দ শোনেন বা গন্ধ পান ততক্ষণ নামাজ ছাড়বেন না।” (নাসায়ি ৩৬)
এ থেকে বোঝা যায় যে, রোগীরা নিয়মিত কুরআন-হাদিস তিলাওয়াত করবে, সকাল-সন্ধ্যার দোয়া নিয়মিত পাঠ করবে এবং শয়তানকে (পাত্তা না দিয়ে) এই অসুস্থ চিন্তাগুলো মাথাচাড়া দিতে দিবেন না, তাহলে তারা মানসিক শান্তি লাভ করতে পারবেন।
সংযুক্তি: ওয়াসওয়াসা রোগের কয়েকটি প্রকারকেই ডাক্তাররা OCD (অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডার) বলে থাকেন। এটার রুকইয়াহ নিয়ে আমাদের বেশ কিছু প্রবন্ধ আছে, কমেন্টে লিংক দেয়া থাকবে, দেখতে পারেন।
২. মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা: – *সহায়ক চিকিৎসা: রোগীকে সহানুভূতি ও উৎসাহ প্রদান করা, যেন সে বোঝে কেউ তার সমস্যার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছে এবং তাকে সাহস ও আশ্বাস দিচ্ছে। – মনোবিশ্লেষণ: OCD-তে মনোবিশ্লেষণ একটি সাধারণ পদ্ধতি, যেখানে রোগীর উপসর্গের প্রতীকী অর্থ খোঁজা হয়। এটি আসলে অতিরিক্ত আত্মনিয়ন্ত্রণের কারণে সৃষ্ট হয় এবং রোগী বিভিন্ন গাইডেড পদ্ধতির মাধ্যমে এই এনজাইটি মোকাবিলা করতে চেষ্টা করেন।
৩. আচরণগত চিকিৎসা (CBT): – এক্সপোজার ও রেসপন্স প্রিভেনশন (ইআরপি): যেমন, ময়লা বা দূষণ নিয়ে অতিরিক্ত ভয় থাকলে রোগীকে এমন পরিবেশে রাখা হয় যেখানে সে ময়লার সংস্পর্শে আসে, কিন্তু হাত ধোয়ার অনুমতি দেয়া হয় না। – মডেলিং বা অনুকরণ: ওয়াসওয়াসার জন্য রোগী যা করতে ভয় পায়, চিকিৎসক এমন কিছু কাজ করেন, যাতে রোগী তার আচরণ অনুকরণ করে ভয় কাটাতে পারে।
৪. ওষুধ: – ট্র্যাঙ্কুইলাইজার বা মৃদু সেডেটিভস: সংকটজনক অবস্থায় রোগীকে শান্ত রাখার জন্য ব্যবহার করা হয়। – অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস: যদি রোগীর মধ্যে হতাশাজনিত লক্ষণ থাকে তবে এটি ব্যবহৃত হয়।
৫. সার্জিক্যাল চিকিৎসা: – OCD এর গুরুতর এবং বিরল ক্ষেত্রে এই চিকিৎসা ব্যবহার করা হয়। মস্তিষ্কের সামনের অংশ ও থ্যালামাসের মধ্যে স্নায়ুতন্তু কেটে দেয়া হয়। এই সার্জারি শুধুমাত্র তখনই প্রয়োগ করা হয় যখন: ১. রোগীর দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা চলেছে এবং কোনো উন্নতি হয়নি। ২. রোগী সমাজের সাথে মানিয়ে নিতে এবং জীবনে এগিয়ে যেতে অপারগ। ৩. নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে রোগটি পারিবারিক ইতিহাসের অংশ, অর্থাৎ বংশগত। তবে এই অপারেশন OCD সম্পূর্ণ নির্মূল করে না, তবে রোগীর মানসিক চাপ ও উদ্বেগের মাত্রা কমিয়ে দেয়।
শেষকথা, ওয়াসওয়াসা রোগীর করণীয় কী?
১. এই চিন্তাগুলোকে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে শয়তানের ক্ষতি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করা এবং দোয়া পড়া। ২. নিজেকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত রাখা, যেন চিন্তা করার সময় না থাকে। ৩. আশেপাশের মানুষের সাহায্য নেওয়া। ৪. জীবনে যতটা সম্ভব নমনীয়তা আনা। ৫. যদি কোনো নির্দিষ্ট স্থান বা কাজ এই রোগের কারণ হয়ে থাকে, তবে তা পরিবর্তন করার চেষ্টা করা। ৬. মানসিক চাপ কমানোর জন্য শান্ত থাকার চেষ্টা করা। ৭. আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখা, তিনিই একমাত্র আরোগ্যদানকারী।
আল্লাহ্ যেন সব রোগীদের আরোগ্য দান করেন এবং তাদের কষ্টের বদলায় সওয়াবের ব্যবস্থা করেন। আমিন।
অনূদিত ও পরিমার্জিত মূল: শায়খ হাসান মুহাম্মাদ ইলিয়াস, ইয়েমেন।