লেখক: সাঈদ আবরারNovember 29, 2024
শাম পৃথিবীর হৃদয়। এখানে অশান্তি মানে পুরো পৃথিবীতে অশান্তি। শামের ইতিহাস ও ভবিষ্যৎ- পৃথিবীর ইতিহাস ও ভবিষ্যৎ। মুসলিম হৃদয়ে আছে শামের বিশেষ মর্যাদা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা শামের ভূমিকে এমন সব গুণে বিশেষায়িত করেছেন, এতো উঁচু মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছেন, যা অন্য কোনো ভূমিকে করেননি। এর মাটি হাজারো নবীর পদস্পর্শে ধন্য হয়েছে। হাজারো সাহাবি এখানে যুদ্ধ করেছেন, বসতি গেড়েছেন এবং এই মাটিতে শায়িত আছেন। রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মে'রাজের রাতে এখানে সফর করেছিলেন। কেয়ামতের পূর্বে দাজ্জালের মোকাবেলায় মু'মিনদের যে সৈন্যবাহিনীর কথা বলা হয়েছে, তাদের প্রধান ঘাঁটি হবে শাম। এ ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে বিশুদ্ধ হাদিসে। উম্মাহর নির্জীবতার সময়ও শাম থাকবে ঈমানের স্নিগ্ধতায় সতেজ।
.
পৃথিবীর শেষ ও চূড়ান্ত সংঘাত, মুসলিম ও কুফফারের মাঝে ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হবে এই মাটিতে। সত্য ও মিথ্যার শেষ লড়াই এখানেই সংঘটিত হবে। হাদিসে যাকে ‘আল-মালাহিম' (দীর্ঘমেয়াদী ধারাবাহিক যুদ্ধ) বলা হয়েছে। মহাযুদ্ধের (মালহামা) যুগে সিরিয়ার রাজধানী দামেশকের ‘আল-গুতা' শহরে মুসলমানরা অবস্থান নেবেন। এই পবিত্র ভূমিতে মাহদির সেনারা একত্রিত হবেন রোমানদের (ইউরোপিয়/পশ্চিমা বাহিনী) মোকাবেলা করার জন্য। সাইয়্যেদেনা ঈসা আলাইহিস সালাম দামেশকের সাদা মিনারায় আকাশ থেকে অবতরণ করবেন। এখানে মুসলিম বাহিনী দাজ্জালের বাহিনীর বিরুদ্ধে মরণপন লড়াই করবে। সাইয়্যেদেনা ঈসা ইবনু মরিয়ম আলাইহিস সালাম দাজ্জালকে নিজের হাতে হত্যা করবেন।
.
কেয়ামতের পূর্বে সিরিয়া থেকে মুসলমানদের রূহ কবয করা হবে। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, শামের ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত হবে হাশরের ময়দান। এ মাটির সবচে বড়ো ফজিলত- এই উম্মাহর বিজয়ী দল (আত-তায়েফাতুল মানসুরা) কেয়ামতের পূর্বপর্যন্ত সিরিয়াতেই অবস্থান করবে। বিশ্বাসঘাতকদের বিশ্বাসঘাতকতা কিংবা আগ্রাসী শত্রুর নিপীড়ন তাদেরকে দমাতে পারবে না। লক্ষ্য করে দেখুন, ক্রুসেডের দিনগুলোতেও, তাতারদের আক্রমণের সময়ও শাম ছিল উম্মাহর অভেদ্য দুর্গ। অতীতের মতো এই ভূমি এখনো প্রতিরোধের দুর্ভেদ্য দেয়াল হয়ে রয়েছে।
.
আজ সিরিয়ার মাটিতে সত্য ও মিথ্যার যে সংঘাত চলছে, কৌশলগত কারণে তা অসামান্য তাৎপর্য বহন করে। উম্মাহর ইতিহাসে সবচে ভয়ানক রক্তপাত, বরং সমগ্র মানব ইতিহাসেরই সবচে বীভৎস রক্তপাতের পর আজ সিরিয়াতে এমন একটি যুদ্ধ শুরু হয়েছে যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব সমস্ত চেনা-জানা পট-পরিস্থিতিকে পাল্টে দিতে সক্ষম। এবং এমনটি হওয়াই আল্লাহর ইচ্ছা। বিশ্বের পরাশক্তিগুলো বহু আগেই সিরিয়ার এই নাজুক পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করেছিল। তাই পাল্লা দিয়ে তারা এই অঞ্চলে স্বার্থ উদ্ধারে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে। একের পর এক কূটকৌশল ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এই পুণ্যভূমিকে তারা ঘায়েল করতে চাইছে। সিআইএ'র এক প্রাক্তন ডিরেক্টর বলেছিল, ‘বাশারকে টিকিয়ে রাখতে পারাটাই এই দ্বন্দ্বের সবচে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল।'
.
আজ পূর্ব-পশ্চিমের ক্রুসেডাররা শিয়া মালাউনদের সঙ্গী হয়ে এই মাটিতে ভয়ঙ্কর গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে আহলুস সুন্নাহর উপর। লাখ লাখ মুসলিম নিহত হয়েছে তাদের হাতে। আলেপ্পোর গণহত্যা, হামা বা হিমসের গণহত্যার পরও ঘুরে দাঁড়িয়েছে উম্মাহর শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা। তীব্র থেকে তীব্রতর আক্রমণ, অন্তর্ঘাত বা বিশ্বাসঘাতকতা কোনো কিছুই টলাতে পারেনি, পারছে না তাঁদের মজবুত ঈমান।
.
আলেপ্পো, হামা-হিমস, ইদলিব- প্রতিরোধ অব্যাহত আছে বছরের পর বছর। দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস রাখুন, এই প্রতিরোধ থামবে না, বিইজনিল্লাহ! ওয়াল্লাহি! ওয়াল্লাহি!! এই প্রতিরোধ নিঃশেষ হবে না। আস-সাদেকুল মাসদুক রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, নিশ্চয় তা বাস্তবায়িত হবে। এই ভূমিতেই উম্মাহর ভাগ্যের চূড়ান্ত ফায়সালা হবে। দাজ্জালকে হত্যা ও ইহূদিদের উপর পৃথিবীর ইতিহাসের সবচে নৃশংস গণহত্যা এই ভূমির মুজাহিদদের হাতেই হবে বিইজনিল্লাহ!
.
শামের বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত দীর্ঘ একটি হাদিসের সামঞ্জস্য পাওয়া যায়-
إِنَّ السَّاعَةَ لاَ تَقُومُ حَتّى لاَ يُقْسَمَ مِيرَاثٌ وَلاَ يُفْرَحَ بِغَنِيمَةٍ...
‘এমন একটি পরিস্থিতির উদ্ভব না হওয়া পর্যন্ত কেয়ামত সংঘটিত হবে না, যখন উত্তরাধিকারও বণ্টিত হবে না, গনিমতের জন্যও আনন্দ থাকবে না'। এরপর তিনি সিরিয়ার দিকে আঙুল তুলে এর ব্যাখ্যা প্রদান করলেন। ‘আহলুল ইসলামের সঙ্গে যুদ্ধ করতে শামে বিরাট এক বাহিনী প্রস্তুতি গ্রহণ করবে। ইসলামপন্থীরাও তাদের মোকাবেলায় প্রস্তুত হয়ে যাবেন'।
.
বর্ণনাকারী বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কি রোমানদের (খৃস্টানদের) কথা বলতে চাচ্ছেন?'
.
ইবনু মাসউদ রাদিআল্লাহু আনহু বললেন, ‘হ্যাঁ। সেই যুদ্ধটি হবে ঘোরতর। মুসলমানরা জীবনবাজি রেখে লড়বে। তাঁরা শপথ নেবে, বিজয় অথবা শাহাদাত ছাড়া ফিরব না। দুইপক্ষ লড়াই করবে। এমনকি রাত যখন উভয়ের মাঝে আড়াল তৈরি করবে, তখন তারা আপন আপন শিবিরে ফিরে যাবে। কোনো পক্ষই (নিরঙ্কুশ) জয়ী হবে না। এভাবে একদল আত্ম-উৎসর্গকারী জানবাজ শেষ হয়ে যাবে। তারপর আরেকদল মুসলমান মৃত্যুর শপথ নেবে, ‘বিজয় অর্জন করব, নয়তো জীবন দিয়ে দেব'। উভয়পক্ষ যুদ্ধ করবে। রাত তাদের মাঝে আড়াল তৈরি করলে চূড়ান্ত ফলাফল ছাড়াই তারা নিজ নিজ শিবিরে ফিরে যাবে। মুজাহিদদের এই জানবাজ দলটিও নিঃশেষ হয়ে যাবে। তারপর আরেকদল মুসলমান মৃত্যুর শপথ নেবে, ‘হয় জয় ছিনিয়ে আনব, নতুবা জীবন বিলিয়ে দেব'। তাঁরা যুদ্ধ করবে। সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে। রাত নেমে এলে উভয়পক্ষ জয় না নিয়ে শিবিরে ফিরে যাবে। এই জানবাজ দলটিও নিঃশেষ হয়ে যাবে।
.
চতুর্থ দিন অবশিষ্ট মুসলমান শত্রুর মোকাবেলায় দাঁড়িয়ে যাবেন। এবার আল্লাহ শত্রুর জন্য পরাজয় অবধারিত করবেন। মুসলমানরা মরণপন যুদ্ধ করবে। এমন যুদ্ধ, যা অতীতে কখনো দেখা যায়নি। পরিস্থিতি এমন দাঁড়াবে, মৃতের পাশ দিয়ে পাখিরা উড়বার চেষ্টা করবে; কিন্তু মরদেহগুলো দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকবে, পাখিগুলো মরে মরে পড়ে যাবে।
.
যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈন্যদের পরিজন তাদের গণনা করবে। শতকরা একজন ব্যতীত কাউকে জীবিত পাবে না। এই অবস্থায় গনিমত বণ্টনে কি আনন্দ থাকবে? উত্তরাধিকার বণ্টনের কি সার্থকতা থাকবে? এই কঠিন পরিস্থিতিতে মানুষ আরো একটি যুদ্ধের সংবাদ শুনবে, যা এরচেও ভয়াবহ। কেউ একজন চিৎকার করে সংবাদ ছড়িয়ে দেবে, 'দাজ্জাল এসে গেছে। তোমাদের পরিবার-পরিজনকে ফেতনায় নিপতিত করবার চেষ্টা করছে।' শুনে মুসলমানরা হাতের জিনিসপত্র ফেলে ছুটে যাবে। দাজ্জালের আগমনের সংবাদের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তাঁরা দশজন অশ্বারোহী প্রেরণ করবে।
.
রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আমি এই দশ ব্যক্তির নাম, তাদের পিতার নাম, তাদের ঘোড়াগুলোর কোনটির কি রঙ তাও জানি। সে যুগে ভূপৃষ্ঠে যতো অশ্বারোহী সৈনিক থাকবে, তারা হবে তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সৈনিক।' (সহিহ মুসলিম : খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-২২৩; মুসতাদরাকে হাকেম : হাদিস নং-৮৪৭১, মুসনাদে আবি ইয়ালা : খণ্ড-৯, পৃষ্ঠা-২৫৯)
.
#তুবা_লিশ_শাম